স্বদেশ ডেস্ক:
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে গেছে প্রায় দেড় হাজারের বেশি প্রার্থী। অথচ নির্বাচন শুরুর আগে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে বিরোধী দলহীন এই স্থানীয় নির্বাচনে যারা সরকারি দলের প্রতীক নৌকা পাবেন তাদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে।
কিন্তু কেন এমন বিপর্যয়? তবে দলটির নেতাদের অনেকেই বলছেন প্রার্থী মনোনয়নে ভুলের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
দলটি কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বিরোধী দল নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকায় তারা বহু জায়গায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেয়াকে অনুমোদন দিয়েছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী একটি বেসরকারি সংস্থা ব্রতী’র শারমিন মুরশিদ অবশ্য বলছেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিল শাসকদলের জন্য আত্মঘাতী এবং দলের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাইরে চলে এসেছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, তৃণমূলকে পাশ কাটিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ায় অনেক জায়গায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে একজোট হয়েছিলেন দলটির অন্য অংশগুলো। আবার এই অংশগুলোকে অনানুষ্ঠানিক সমর্থন বা ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোটাররাও।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, আজই গণভবনে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রীর সাথে আলোচনা করবেন তারা।
দলের ঘাঁটিতে নৌকার হার
প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়ন পরিষদের সাত দফায় নির্বাচন শেষ হয়েছে সোমবার।
নির্বাচনে প্রায় ১৬০০’র বেশি ইউনিয়নে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই নেতা যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
এর মধ্যে এমন কিছু এলাকা আছে যেসব এলাকাগুলো দীর্ঘকাল ধরেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত এলাকা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত।
এর মধ্যে আছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী, পাবনা সদর উপজেলা ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর।
বোয়ালমারীর ১০টি ইউনিয়নের ৯টিতেই নৌকার প্রার্থীরা হেরে গেছে এই নির্বাচনে। এর মধ্যে জামানত হারিয়েছেন দলটির তিনজন প্রার্থী।
বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন মুসা মিয়া শুধু বলেছেন, ‘এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমি আর কিছু বলতে পারবো না।’
এই এলাকায় আওয়ামী লীগের তিন নেতার মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব। এ তিন নেতা হলেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার। আর এখন এমপি মনজুর হোসেন।
এর আগে নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনের ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতেই পরাজিত হয়েছে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরে গেছেন।
পাবনায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। জেলা সদরের ৯ ইউনিয়নের সব কটিতে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল করিম বিবিসিকে বলছেন, নির্বাচনের এমন ফল নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন তারা।
‘দল থেকে তদন্ত করছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চিঠিও দিয়েছি। এ জবাব আমরাও চাই যে কেন নৌকার প্রার্থীরা হারলো। স্থানীয় নেতা ও এমপিরাই এগুলো ভালো বলতে পারবেন,’ বলছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল করিম।
অর্থাৎ তার কথায় এটি স্পষ্ট যে স্থানীয় নেতা ও এমপিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের সবগুলোতেই চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হেরে গেছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলকে অবহেলা করা হয়েছে বলেই এমন অবস্থা হয়েছে।
‘জেলা কমিটি তৃণমূলকে পাশ কাটিয়ে প্রার্থী দিয়েছে যা আমরা কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। তাকে তৃণমূলের রেজুলেশন দেখিয়েছি যে আমরা প্রার্থী হিসেবে কাদের সুপারিশ করেছিলাম আর কারা মনোনয়ন পেয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।
কুমিল্লায় ২৩টি ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা জিতেছে মাত্র ৭টিতে, ১৫টি বিদ্রোহী ও ১টিতে স্বতন্ত্র। অথচ জেলা দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রী আছেন।
তবে সেখানকার নেতারা এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা
মোট সাত দফায় শেষ হওয়া এ নির্বাচনে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। তবে এ সহিংসতার বেশিরভাগই হয়েছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে যেসব হিসাব দেয়া হচ্ছে তাতে এসব সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনকে থেকে পাওয়া অনানুষ্ঠানিক হিসাবে অন্তত ১ হাজার ৬৯৪টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পেয়েছে।
অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রায় ১০০ সহ মোট ২ হাজার ৪৩ জন নৌকা প্রতীক নিয়ে জয় পেয়েছেন।
যদিও সাত দফার মোট ফল চূড়ান্ত হলে এ সংখ্যায় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
প্রথম ধাপে ১৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার প্রার্থী জয়লাভ করেছে। আর স্বতন্ত্র হিসেবে জয় পেয়েছিলেন ৪৯ জন প্রার্থী। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি, জাতীয় পার্টি-জেপি ও জাতীয় পার্টি-জাপা পেয়েছে তিনটি করে চেয়ারম্যান পদে জয় পায়।
পরে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪টির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পায় ৪৮৬টিতে এবং ৩৩০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান।
এ ধাপে জাতীয় পার্টি ১০টিতে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চারটি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত মজলিশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি করে ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে।
তৃতীয় ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদে সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত ৯০৮টি ইউপির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৪৫টিতে এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৪২৬টিতে জয়ী হয়েছে।
অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ৯৯ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের।
চতুর্থ ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীরা প্রায় অর্ধেক ইউনিয়নেই হেরে গেছেন। এর মধ্যে ১৬২টি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না।
এ ধাপে ৭৯৭টি ইউনিয়ন পরিষদের সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৫০টিতে আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৮৯টিতে।
পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও চেয়ারম্যানপদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ধাপে ৭০৮টি ইউপির মধ্যে ৬৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতেছে ৩৩২ জন আর স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছে ৩৪৯ জন।
তবে স্বতন্ত্ররা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।
তবে ষষ্ঠ ধাপে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯৫টি আর আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জিতেছে ১১৭টি ইউনিয়ন পরিষদে।
আর সর্বশেষ সোমবার সপ্তম ধাপের ১৩৮টির মধ্যে সবগুলোর মধ্যে ফল এখনো জানা যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত ৫৮টিতে আওয়ামী লীগ ও ৩৫টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
যা বলছে আওয়ামী লীগ
দলটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলছেন নির্বাচন নিয়ে তারা আলোচনা করে দলীয় পদক্ষেপ নেবেন।
তবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন স্থানীয় নির্বাচনে এলাকার ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
‘আমাদের দুটি সমস্যা হয়েছে – তাহলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত সরাসরি অংশ না নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিয়েছে। আবার ভোটারেরা যেন একাধিক প্রার্থী পায় সেজন্য দলের নেতাদের অনেক জায়গায় এলাউ করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কোথাও হারেনি। তবে নেতৃত্বের যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে সেটি সামনে স্থানীয় সম্মেলনে ঠিক হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ শিগগিরই জেলা, থানাসহ স্থানীয় পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনকে গোছানোর পরিকল্পনা করছে।
শাসক দলের জন্য আত্মঘাতী নির্বাচন
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, এবারের নির্বাচনটি ছিল সহিংস ও শাসক দলের জন্য আত্মঘাতী।
‘আওয়ামী লীগের বিরোধী যারা অনানুষ্ঠানিক অংশ নিয়েছে তারাই বরং সফল। এ নির্বাচন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভিতকে আহত করেছে কারণ দলের প্রবল সাংগঠনিক সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু কয়জনকে বিদ্রোহী হিসেবে বাদ দিবে তারা? বাদ দিলে কি সুখকর হবে?’
তিনি বলেন, দলের মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তারা কিভাবে সামাল দেয় সেটিই হবে এখন দেখার বিষয়।
সূত্র : বিবিসি